নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ | প্রিন্ট | 243 বার পঠিত
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি বর্তমানে এমন এক অস্থিরতায় আটকে গেছে যা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সুস্পষ্ট পথ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ভেতর পিতা-পুত্রের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাও দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
একদিকে অভ্যন্তরীণ বিভেদ চলছেই এবং এ অবস্থায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মোট ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে যা যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতির অনেকটা বাইরে। কয়েক বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ব্যাংকটি দীর্ঘদিন ধরেই দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির অভাবে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একাধিকবার নির্দেশ দেওয়া ও পরিদর্শন সত্ত্বেও পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়নি।
বোর্ডরুমে পিতা-পুত্র দুই পক্ষ:
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি-এর বোর্ড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল আজিজ ও ভাইস চেয়ারম্যান তার ছেলে একেএম আবদুল আলিম। পিতা-পুত্র বোর্ডে থাকলেও মূলত তারা দুইভাগে বিভক্ত। একইভাবে ১৬ সদস্যের বোর্ড এখন দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছে। সূত্র জানিয়েছে একটি পক্ষের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, আর অপর পক্ষের নেতৃত্বে আছে তার ছেলে ভাইস চেয়ারম্যান একেএম আবদুল আলিম। ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাভক্ত থাকতে হয় সদস্যদের। অভ্যন্তরীন সূত্রে জানা যায়, বোর্ডের কোন্দলে বিপদে আছেন এমডি নিজেও। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হাবিবুর রহমানকে বহাল রাখা হবে নাকি অব্যাহতি দেওয়া হবে- এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র বিরোধ রয়েছে। ছেলে আব্দুল আলিম পক্ষের কর্মকর্তাগণ এমডির বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তুললেও, অন্যপক্ষ বলছে এগুলো কেবল ক্ষমতা নেওয়ার কৌশল। বোর্ড মিটিংগুলো প্রায়ই অপ্রীতিকর তর্কে শেষ হওয়ায় ব্যাংকের নীতি নির্ধারণ, নিয়োগ-বদলি বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সবই স্থবির হয়ে আছে। কর্মকর্তাদের ভাষায়, ‘ব্যাংক পরিচালনার চেয়ে কে কার লোক বসাবে এই বিষয়টাই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।’
আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ধস:
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পৌঁছে গেছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকায় যা প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বের জন্যই বড় হুমকি। মাত্র কয়েক বছর আগেও এ হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। রাজনৈতিক পরিবেশ পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বহু লুকানো খেলাপি ঋণের তথ্য উঠে আসায় পরিস্থিতি আরও উন্মোচিত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে বহু পুরোনো ঋণ নতুন করে ‘খেলাপি’ শ্রেণিতে যুক্ত হওয়ায় ব্যাংকের প্রকৃত দুরবস্থা প্রকাশ্যে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে জানিয়েছেন পরিচালকদের অন্তর্কলহ অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের আর্থিক স্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। এ বিষয়ে কথা হলে ব্যাংকের আর্থিক বিভাগের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জনসংযোগ বিভাগ অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করলেও কোন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করতে চায়নি।
মানবসম্পদ প্রধানের নতুন নিয়োগ কিন্তু কর্মীদের আস্থা কম:
এমন অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেই স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক নতুন মানবসম্পদ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে মোহাম্মদ কায়সার আলম মজুমদারকে। প্রায় দুই দশকের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে এ নিয়োগ আশাবাদের চেয়ে উদ্বেগই বেশি তৈরি করেছে। কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করছেন ব্যাংকের গভীর কাঠামোগত সংকট ও বোর্ডরুমে রাজনীতিতে তিনি কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তীব্র সন্দেহ রয়েছে। মানবসম্পদ বিভাগের নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও কর্মীদের অভিযোগ পরিচালনা পর্ষদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব না থামলে বাস্তবে কোনো কাঠামোগত সংস্কার সম্ভব নয়। কারণ অতীতে এই বিরোধের কারণে শ’খানেক কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
অনিশ্চয়তা ও নেতৃত্ব সংকটে ডুবে থাকা একটি প্রতিষ্ঠান:
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব, শেয়ারহোল্ডারদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো সব মিলিয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এখন একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি সমগ্র ব্যাংকিং খাদের আস্থা সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও অবনতির দিকে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক যে ব্যাংক একসময় সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচিত হতো এখন নেতৃত্ব সংকট, আর্থিক অনিয়ম ও আভ্যন্তরীণ বিভাজনের কারণে এমন এক কঠিন বাস্তবতায় পড়ে গেছে, যার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিচালনা পর্ষদ সম্পর্কে ওঠা বিরোধ ও ব্যক্তিগত সম্পর্কজনিত বিভাজনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ব্যাংকের দাবি বোর্ডে মতভিন্নতা থাকলেও তা কখনোই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলাবস্থা তৈরি করেনি এবং পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বের মতো ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয় বোর্ড পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত নয়। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নিয়ে যে তথ্য প্রচারিত হয়েছে তা আংশিক সত্য কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক শ্রেণিকরণ নীতিমালার কারণে অন্যান্য ব্যাংকের মতোই তাদের খেলাপি ঋণ সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কর্মী বরখাস্তের বিষয়েও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্নীতি, জাল সনদ ও অযোগ্যতার প্রমাণের ভিত্তিতেই সীমিতসংখ্যক কর্মকর্তাকে নিয়ম অনুসারে অপসারণ করা হয়েছে; গণহারে বরখাস্তের অভিযোগ সত্য নয়। নতুন মানবসম্পদ প্রধান নিয়োগকেও তারা স্বাভাবিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়া বলে উল্লেখ করেছে।
Posted ৭:৪৬ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy